নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমি ভীষণ পরিমাণ অপছন্দ করি। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাটার উপর যখন শিক্ষার নামে ১২ঘরের নামতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন আমার বাচ্চাটার জন্য মায়া হয়, আর শিক্ষা ব্যবস্থার খেতায় আগুন দিতে ইচ্ছে করে। একটা প্লে পড়ুয়া বাচ্চাকে লেডিস ফিঙ্গারের অর্থ শেখানোর মানেটা আজও আমার বোধগম্য হয় না৷ ক্লাস নার্সারির বাচ্চা যখন ১০০টা করে সাধারণজ্ঞানের প্রশ্ন গোগ্রাসে গিলে খায়, তখন আমার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বদহজম হওয়া অবশিষ্ট শিক্ষাংশটুকু উগড়ে দিতে ইচ্ছে করে।

আমার মনে পড়ে, ক্লাস থ্রিতে থাকতে আমি যতগুলো সাধারণ জ্ঞান আর শব্দার্থ পড়েছি, তার সিকিভাগও আমার মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। বইয়ের সবচেয়ে কঠিন কঠিন শব্দগুলো বেছে বেছে পড়ানোর পেছনের রহস্যটা আজও আমার অজানা। শিক্ষার্থীদের সবসময় চাপের মধ্যে রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ আমি খুঁজে পাই না। যেখানে যত বেশি বইয়ের ওজন সেখানে তত বেশি পড়াশোনা ভালো, এমন একটা ধারণা যেন জন্মেছে আমাদের মধ্যে। ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি?

কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো রীতিমতো শিক্ষার নামে ব্যবসা করছে। বছরের শুরু থেকে কোচিং করতে হবে এবং সেটা বাধ্যতামূলক। খেয়াল করলে দেখবেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন বেশি নিলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন সন্তোষজনক নয়। এছাড়া ক্লাস টেস্ট, মান্থলি টেস্ট নামক কিছু পরীক্ষার নামে সেখানেও রয়েছে নিজের পকেট ভারী করার পদ্ধতি। অবশ্য এখানে দায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাতার নয়, দায় পুরো সিস্টেমটারই।

টিউশনির ক্ষেত্রেও দেখা যায় এক অদ্ভুত সিস্টেম। ভালো রেজাল্ট শো আপের জন্য আগের রাতে প্রশ্ন ফেরি হয়। হ্যাঁ কথাটা আমি ফেরি অর্থেই প্রয়োগ করলাম। সরাসরি আদান-প্রদান না হলেও নাচ-গানের রিহার্সাল করানোর মতো করে প্রশ্নপত্রে আসা প্রশ্নগুলোই তোতা পাখির বুলি আউড়ানোর মতো করে শেখানো হয়।
আর আমরাও এগুলোতে তাল মেলাতে পছন্দ করি। সবকিছুতে কম্পেয়ার করতে পছন্দ করি। আমার ছেলে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড পায়। তোমার ছেলে তো নাইন্টি নাইন। কোন ক্ষেতের মূলো হে?

আসলে আমরা এক অদ্ভুত সিস্টেমের মধ্যে বসবাস করি যেখানে আমাদের শিশুরাই আমাদের দেখে আতঙ্কগ্রস্থ থাকে। ভারী ব্যাগ নুইয়ে পড়া কাঁধটা জানে এর ওজন ঠিক কতখানি। খেলার জন্য ছটফটানি মনটা জানে আলফাবেট কতটা কঠিন একটা জিনিস।
আমরা আমাদের ছেলেমেয়েকে খেলার ছলে পড়াতে পারি না। এটা কি আমাদের আফসোস হওয়ার মতো বিষয় নয়?

আমাদের সময়ে বাবা-মা’রা যেখানে চিন্তিত থাকতো সন্তানের বয়স ৩ বছর হয়ে গেল, এখনো বিছানায় প্রসাব করা নিয়ে, সেখানে আমরা মরিয়া হয়ে থাকি একটা বাচ্চার কথা ফোটার সাথে সাথে পড়া শেখানোর জন্য। একটা বাচ্চা যখন বাবা-মা বলে ডাক শেখে তখন যতটা না খুশি হই, তার থেকে বেশি খুশি হই ক, খ… বলা শিখলে। কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!

মাঝেমধ্যেই অফার আসে টিউশনি পড়ানোর জন্য। বয়স জিজ্ঞেস করলে বলে ৩+ অথবা ৪+। সাথে এটাও জুড়ে দিয়ে বলে, ছেলে অনেক দুরন্ত। সারাদিন খেলাধুলা করে। পড়ার চাপে থাকলে অত দুষ্টুমি করতে পারবে না। আমি সত্যিই বিষয়টাতে অবাক হয়ে যাই। এতটুকুন একটা বাচ্চাকে আমি কী পড়া শেখাবো সেটা ভাবলেই নিজের মাথার চুল নিজের টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। অভিভাবকদের ধারণা যত কম বয়স থেকে পড়া শেখানো যাবে তত বেশি শিখতে পারবে। এই অমূল ধারণাটা কবে পাল্টাবে আপনাদের?
অনেক অভিভাবককে তো দেখা যায় ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিয়ে বের হলে আরেকটা পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। এত কেন হ্যারাসমেন্ট ভাই? একটু তো দম নিন।

আসলে যুগের সাথে সাথে আপডেট হতে হতে আমরা অভার আপডেট হয়ে গেছি। বিছানায় প্রসাব করার হাত থেকে বাচতে বাচ্চাকে ডায়পার নামক জঞ্জালে জড়াতে পারছি, অথচ বিনোদনের একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে পারছি না। ছেলেমেয়েরা আত্মীয়স্বজনকে দেখলে সালামের বদলে হাই, হ্যালো বলতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো ইংলিশ মিডিয়ামের বদৌলতে ফটর ফটর ইংরেজিও ঝারছে। আর আমরা সেটাতে বাহবা দিচ্ছি। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিষ্টাচার, নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের টনক নড়ছে না। এর দায় কি আমাদের নয়?

আমি জানি এই সিস্টেমটা একদিনে হয়নি, একদিনে বদলানোও যাবে না। কিন্তু আমরা একটু তো চেষ্টা করতে পারি নিজেদের জায়গা থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ দিতে। নয়তো দিনশেষে আদরের ছেলে-মেয়েটাই হয়তো আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠতে পারে, “Your teaching method is very bad and you are a defeated person in my eyes.”
আমরা মানুষ হবো মানুষের জন্য, জীবনের জন্য।
আমরা চলুন আমরাই হয়ে যায়।